আটা ও ময়দার মধ্যে কোনটি বেশি স্বাস্থ্যকর?
ময়দা না আটা—কোনটা শরীরের জন্য ভালো, তা নিয়ে রয়েছে বহু বিভ্রান্তি। পুষ্টিগুণ, হজম, রক্তে শর্করা ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের প্রভাব বিবেচনায় কোনটা আমাদের জন্য উপকারী সেটা আমাদেরই যাচাই করতে হবে।
রুটি আমাদের দৈনন্দিন আহারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা ময়দা ও আটা উভয়ই ব্যবহার করে থাকি। এখন ময়দার রুটি বা আটার রুটি—কোনটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ নয়।
উপরন্তু ডায়াবেটিস রোগীদের খাবার নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। ভাত না রুটি কিংবা রুটি হলে আটার না ময়দার, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। কেউ বলেন, ময়দা খেতে সমস্যা নেই, কারও মত আটা খেতে হবে। এসব আমাদের বিভ্রান্ত করে বৈকি। আর খাওয়ার নিয়মে মারাত্মক ভুল হয়ে যায় এই বিভ্রান্তির কারণে।
ময়দা না আটার রুটি—কোনটা ভালো
আটা আর ময়দা দুটিই গম থেকে তৈরি হয়, তবে পার্থক্য হয় শুধু প্রক্রিয়াকরণের সময়। ময়দা তৈরিতে গমের বাইরের খোসা ও ভ্রূণ ফেলে দেওয়া হয়। ফলে দেখতে ধবধবে সাদা। অনেক ক্ষেত্রে ব্লিচিং, প্রিজারভেটিভ যোগ করার ফলে রং ও টেক্সচার সাদা, মসৃণ, নরম হয়। আর আটায় গমের পুরো দানার খোসা, ভ্রূণ ও শাঁস—সবই থাকে। আটা সাধারণত অপরিশোধিত বা কম প্রক্রিয়াজাত হয়। এ ছাড়া আটা রুক্ষ ও ঘন হয়ে থাকে। এর রং হয় বাদামি।
হজমশক্তি ও কোষ্ঠকাঠিন্য
পুষ্টিগুণে আটা এগিয়ে আছে ময়দার চেয়ে। হজমশক্তির জন্য ফাইবার একটি বড় উপাদান, যা কোষ্টকাঠিন্য দূর করতেও সাহায্য করে। ময়দার চেয়ে আটায় অনেক বেশি ফাইবার থাকে। এ কারণে হজম ভালো হয়। পেট পরিষ্কার করতে সহায়তা করে। গমের গ্লুটেন একটি মজার ক্যারেক্টার, যা বেশি হলে পেট ফাঁপা হয়ে হজমে বাধা দেয়। এই গ্লুটেন ময়দায় বেশি আর আটায় কম থাকে। আটার গ্লুটেন ফাইবারের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে হজমকে সহজ করে। এ ছাড়া আটা কোষ্ঠকাঠিন্য, পাইলস, ডাইভার্টিকুলাইটিস প্রতিরোধে সহায়ক।
রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ (ডায়াবেটিস)
ময়দায় গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) উচ্চামাত্রায় (৭০-৮৫) থাকে, যার প্রভাবে রক্তে শর্করা দ্রুত বাড়ে। অন্যদিকে আটায় জিআই তুলনায় (৫০-৬০) কম থাকে। ফলে ধীরে ধীরে শর্করা ছাড়ে, ইনসুলিন কম লাগে। তাই আটা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিরাপদ।
ওজন নিয়ন্ত্রণ
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে আটার তৈরি খাবার খেতে হবে। আটায় ক্যালরি কম, ফাইবার বেশি। এ কারণে ধীরে ধীরে হজম হয়। খিদা কম লাগে। আটায় তৈরি খাবারে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা থাকে। এর উল্টোটা হয় ময়দায় তৈরির খাবারের ক্ষেত্রে।
দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যপ্রভাব
ময়দা হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, রক্তে এলডিএল বাড়ায়, ইনফ্লামেশন বাড়াতে পারে। অন্যদিকে আটায় অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট থাকায় এর ঝুঁকি কমায়। আটায় পুষ্টি বেশি থাকায় এটা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ও নিরাপদ।
কেন এই তুলনা জরুরি
ডায়াবেটিসে শর্করা স্পাইকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাই মূল লক্ষ্য। ময়দা ও আটার উৎস অভিন্ন হলেও প্রক্রিয়ার কারণে তাদের পুষ্টি ও গ্লুকোজ প্রভাবকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে। ময়দায় পোস্টপ্র্যান্ডিয়াল স্পাইক ৮০-১২০ মিলিগ্রাম (২ ঘণ্টা) করে আর আটায় ৪০-৬০ মিলিগ্রাম স্পাইক করে। এ কারণে আটা নিরাপদ।
আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনের এক গবেষণা প্রমাণ করে, ময়দার চেয়ে আটা শ্রেয়। তারা ময়দার বদলে আটা খাওয়ার সুপারিশ করে, কিন্তু বিশ্ব খাদ্যব্যবস্থায় বিশাল পুঁজি লগ্নি করা এই ইন্ডাস্ট্রির জন্য অন্য একটি দরজা খোলে। আর সেটা হলো ময়দা থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় গ্লুটেন ফ্রি করা। এ কারণে উন্নত বিশ্বে গ্লুটেন ফ্রি ময়দার রুটি, বিস্কুট, বেকারি আইটেম পাওয়া যায়। এর দাম একটু বেশি।
তারাও বোঝে যে গ্লুটেন ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য হানিকর। এটা পুঁজিব্যবস্থায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন একটি ফাঁক তৈরি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই গ্লুটেন ফ্রি ময়দা আমাদের দেশে হয় না। ফলে ময়দা ডায়বেটিস রোগীদের জন্য স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ খাদ্য উপাদান নয়।
আপনার লক্ষ্য যদি হয় সুস্বাস্থ্য, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, ওজন কমানো, দীর্ঘায়ু হওয়া, তাহলে আটার রুটি খাবেন। আর যদি শুধু স্বাদ, নরম টেক্সচার, তাহলে ময়দার রুটি খেয়ে মজা নিতে পারেন।